অপ্রত্যাশিত চিঠি
-রুদ্র প্রসাদ
দ্বিতীয় পর্বের পর…..
( ০৬ )
ওপরের ঘরে এসে, দরজার দিকে মুখ করে বসে, হ্যান্ডিক্যামের রেকর্ডিংটা ল্যাপটপে দেখতে লাগলাম । দেখতে দেখতে কয়েকটা জায়গায় খটকা লাগল । একটু ভেবে দেখলাম, যেভাবে আমাকে চোখে চোখে রাখা হয়েছে, তাতে করে ফোনে এসব আলোচনা করার ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো । হোয়াটস্অ্যাপে চ্যাটের মাধ্যমে ভাইকে মোটামুটি বিশদে সব বললাম । আর এ ও বললাম যে ‘চিঠিতে লেখা কথার সাথে দাদুর এখনকার হাবভাব ঠিক মিলছে না’ । সব শুনে ভাই বলল সতর্ক হয়ে সাবধানে থাকতে । আরও কিছু শলা-পরামর্শের পর চারটের দিকে উঠে পড়লাম ।
ভাবলাম তাজপুর সৈকতে কিছু সময় ঘুরে আসি । নিচে নেমে আসতেই সেই খিটকেল মাঝবয়সী লোকটাকে সামনে পেলাম । জিজ্ঞেস করে জানলাম, তার নাম আবীর লাল মিশ্র, বাড়ি উড়িষ্যার নয়াগড়ে, সে আবার না কি দাদুর ম্যানেজার । যাই হ’ক, তাকে ‘একটু ঘুরে আসি’, বলে বেরিয়ে পড়লাম ।
বালিসাই-তাজপুর সি-বীচ রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে, রাস্তার ধারে ফুটে থাকা একটা অচেনা জংলা ফুল দেখে ছবি তোলার সাধ জাগল । সাইড ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করতে গিয়ে হঠাৎ অজানা বিপদের আভাস পেয়ে, আন্দাজ করেই পেছনে ফিরলাম । দেখি, একটা গাঢ় নীল রঙের পিক-আপ ভ্যান প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে । প্রায় শেষ মুহূর্তে বামদিকে ঝাঁপ দিয়ে কোনোক্রমে রক্ষা পেলাম । উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই ভ্যানটা অনেকটা এগিয়ে গেছে । নম্বর প্লেটটা দেখতে পেলেও নম্বরটা পড়তে পারলাম না । তবে ভ্যানটার পেছনে, বামপাশে একটা লাল রঙের তিনকোনা রিফ্লেক্টর দেখতে পেলাম, বিকেলের আলো পড়ে চকচক করছে । উঠে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে খেয়াল করলাম, অপ্রস্তুতভাবে পড়লেও বিশেষ চোট লাগেনি । পুরো ব্যাপারটা কোনো আনাড়ি ড্রাইভারের কেরামতি ভেবে ভুলতে চাইলেও মনের খচ্-খচানিটা গেল না । ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি নিয়েই প্রায় শুনশান রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছালাম সমুদ্রের কাছে । দেখলাম, তুলনামূলকভাবে প্রচার কম বলেই হয়ত এখানে ভিড়টা অনেক কম । ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটা দোকান, মূলতঃ রেস্টুরেন্ট, একটা অস্থায়ী ওয়াচ টাওয়ারের সাথে এলোমেলো গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের সারিতে সাজানো, বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সাগর সৈকতটাকে এই পড়ন্ত বেলায় বেশ মোহময়ী লাগছিল । চমৎকার হাওয়াতে মনটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠতেও বিশেষ সময় লাগল না । কয়েক জোড়া চোখের দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ দেখে একটু অস্বস্তি হলেও খুব একটা আমল না দিয়ে, একটু এগিয়ে গেলাম, তারপর বালির ওপর বসে লাল কাঁকড়ার দৌড় আর ঢেউয়ের আনাগোনা দেখতে মন্দ লাগছিল না । লোকজনও বেশ কম । বেশ সময় কাটছিল । হঠাৎ চোখে পড়ল, সামনে এক সুন্দরী তন্ময়ভাবে ঝিনুক কুড়িয়ে চলেছে । আশেপাশে কোনো সঙ্গী-সাথী দেখলাম না । আর যারা আছে সব যে যার মত করে সূর্যাস্ত উপভোগে ব্যস্ত । বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেও বয়সের সঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না, তবে পঁচিশের আশেপাশেই হবে । তার দিকেই তাকিয়ে আছি – বুঝতে পেরেই বোধহয় ভ্রূ কুঁচকে একবার তাকালো, চোখাচোখি হতে আমি অন্যদিকে মুখ ঘোরালাম । এদিক-ওদিক তাকাতে খেয়াল করলাম, সেই কয়েকজোড়া চোখের দৃষ্টি, তখনও আমার ওপরই রয়েছে । খানিকটা বিরক্ত হয়েই উঠে পড়লাম ।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে । ইতস্ততঃ ঘুরতে ঘুরতে ফেরার পথ ধরলাম । হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানিতে বুঝলাম, মেঘ ভালোই জমেছে । তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ফিরতে ফিরতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । বাতাসের বেগ বাড়তে লাগল ।
( ০৭ )
ফিরে এসে দেখি, যথারীতি লোডশেডিং আর দাদু চিন্তিতভাবে বারান্দায় পায়চারি করছেন । আমাকে দেখেই বললেন, “যাক, ফিরেছ ভালোই হয়েছে । বৃষ্টি আসতে চিন্তায় পড়ে গেছিলাম” । আমি “বিশেষ ভিজিনি”, বলে পাশ কাটিয়ে ওপরের ঘরে এসে, ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বার করে, যখন দেখলাম সব ঠিক আছে, একটু স্বস্তি পেলাম । জামাকাপড় পাল্টে নিচে এসে দেখি, দাদু নেই । রতনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, দাদু ল্যাবে গিয়েছেন । আর কথা না বাড়িয়ে চা-জলখাবার খেয়ে ওপরে এলাম ।
ঘরে এসে কয়েকটা ফোন সেরে সারাদিনের কথা ভাবছিলাম, এমন সময় হোয়াটস্অ্যাপে ভাইয়ের দুটো মেসেজ এলো । প্রথমটা পড়ে আশাহত হলাম – ‘ঘুমের ঔষধের কোনো অ্যান্টিডোট নেই’ । অন্যটা পড়ে কিছুটা যেন আশা জাগল । ওর এক বন্ধুর জামাইবাবুর বন্ধু, সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত, পুলিশ অফিসার – বর্তমানে তিনি এখন অ্যাডিশনাল এসপি হিসাবে কাঁথিতে রয়েছেন, প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারেন । মনে পড়ল, ভদ্রলোকের সাথে একবার ব্যক্তিগতভাবে আলাপ হয়েছিল । এখন মনে রেখেছেন কি না, কে জানে । এরপর ফেসবুক ঘাঁটাঘাটি করে সময় কাটানোর চেষ্টা করলেও মাথায় কালকের একটা পরিকল্পনা করছিলাম ।
বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে । রাতে খাওয়ার সময়ও দেখলাম হরিদাদু নেই । জিজ্ঞেস করাতে দাদু বললেন, “ও একটু দেশের বাড়ি গেছে । চার-পাঁচদিন পর ফিরবে ।” খেতে বসে লক্ষ্য করলাম, আমাকে যা যা খেতে দেওয়া হয়েছে, দাদুকেও তাই দেওয়া হয়েছে – শুধু একটা পদ ছাড়া । দাদু সেটাকেই দেখিয়ে বললেন, “এটা আজকের স্পেশাল, সামুদ্রিক মাছের স্পাইসী কারি” । যখন দেখলাম সব খাওয়ারই এক জায়গা থেকেই দুজনকে পরিবেশন করা হচ্ছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হ’ল না যে ঐ স্পেশাল আইটেমটাই যত নষ্টের গোড়া । কিছু মেশানো থাকলে ওটাতেই থাকবে । বাকি সব খাওয়ার পর ওটাকে নামমাত্র মুখে ছুঁইয়ে উঠে পড়লাম ।
বাইরে বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে । ওপরে এসেই সতর্কতামূলকভাবে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করার চেষ্টা করে দেখলাম, ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয় । বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় কিছুটা সফল হলাম বটে, কিন্তু নিঃসংশয় হতে পারলাম না । গতরাতের মতো না হলেও একটা হালকা ঝিমুনি আজও এলো, তবে অনেক দেরিতে । মনে মনে কাল সারাদিনের কর্মসূচিটা ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লাম ।
( ০৮ )
গতকালের তুলনায়, আজ বেশ সকালেই ঘুম ভাঙল । উঠে পড়ে বেরোতে গিয়েও বেরোলাম না । ঘরে বসেই মনে মনে সারাদিনের কর্মসূচির একটা খসড়া করে ফেললাম । কিছু সময় পর, গতকালের মতই নিচে এলাম । আজও দাদুকে দেখতে পেলাম না । জলখাবার খেয়ে বাড়ির চারপাশে ঘুরে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল, পূর্বদিকে বাড়ির একেবারে গা-ঘেঁসে একটা ঝাঁকড়া নিম গাছ । দেখে মনে মনে ভাবলাম, গাছটা প্রয়োজনে খুব কাজে আসতে পারে । আরও একটু এগিয়ে যেতে চোখে পড়ল একটা বড়-সড় পুকুর, বাঁধানো ঘাটও রয়েছে একটা । কিন্তু চারপাশে আম-জাম-পেয়ারা-শিমুল-শীরিষ-নারকেল ইত্যাদি গাছ এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে, বাড়ি থেকে পুকুরটা প্রায় দেখাই যায় না ।
পুকুরের পাড় বরাবর ঘুরে পৌঁছালাম ল্যাবের পেছনের দিকে । দেখি ল্যাবের সেদিকের দেওয়ালটা ইঁটের । দেওয়ালের ওপরের দিকে একটা বড় গর্ত, যেটা পাশের একটা বকুল গাছে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে । ‘হয়ত এক্সস্ট ফ্যান লাগানোর জন্য করা হয়েছিল, পরে আর লাগানো হয় নি’, পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হ’ল । একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল একটা বিশাল মাচা বাঁধা হয়ে আছে । জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন লতানে গাছ লাগানো আর মাচা থেকে ঝুলে আছে ঝিঙে, চিচিঙ্গে, উচ্ছে, চাল-কুমড়ো, কুমড়ো আরও কত কি ! তার একপাশে সারিবদ্ধভাবে লাগানো ঢ্যাঁড়শ গাছও দেখলাম । ফল ধরে থাকায় গাছগুলো চিনতে অসুবিধা হ’ল না । সামনে একটা বিরাট চালতা গাছ দেখে এগিয়ে দেখি, পাতাসহ একটা চালতার ওপর ফড়িং বসেছে । ছবিটা তুলতে তুলতেই পেছন থেকে আওয়াজ এলো, “কি … কেমন দেখছ ?”
ভিউ ফাইন্ডার থেকে চোখ না সরিয়েই জবাব দিলাম, “দারুণ !” ছবি তোলার পর দাদুকে বললাম, “কালকের বৃষ্টির জন্য ক্যামেরার লেন্সে জলীয় বাষ্প জমে গেছে । পরিষ্কার না করালে লেন্সটার ক্ষতি হতে পারে । তোমার কোনো চেনাশোনা দোকান আছে ? কাছাকাছি কোথাও । তাছাড়া কিছু কেনাকাটাও করার ছিল” ।
দাদু একটু ভেবে বললেন, “এখানে কেনাকাটা করার মতো কি আর আছে । তুমি বরং কাঁথি চলে যাও । ওখানে কয়েকটা বড় দোকান আছে । তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পেলেও পেতে পার” । মনে মনে ভাবছিলাম, কি করে কাঁথি যাওয়ার বাহানা করব, এখন নিজে থেকে বলায় সুবিধাই হ’ল । দেরি না করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কাঁথির উদ্দেশ্যে ।
( ০৯ )
কাঁথি সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে জিপিএস থাকলেও আশেপাশে জিজ্ঞেস করতে করতে চললাম । কিছুটা এগিয়ে এসে পড়লাম কাঁথি সুপার মার্কেটে । ভেতরে ঢুকে দেখি, নামেই সুপার মার্কেট ! আদতে একটা বড় বাজারই বলা চলে । এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে এগোচ্ছিলাম, এক জায়গায় চোখে পড়ল ছোট ছোট গামছা বিক্রী হচ্ছে । নেড়ে-চেড়ে বুঝলাম, এগুলো বেসিনের পাশে রাখা তোয়ালের বদলে বা ঘরদোর মোছার কাজে লাগতে পারে । একটা মতলব মাথায় আসতেই বেশ কয়েকটা কিনে নিলাম । বেশ সস্তাই বটে । আর একটা দোকান থেকে কিনলাম শক্ত অথচ হালকা নাইলনের দড়ি । আর বেশি দেরি না করে পা চালালাম গন্তব্যের দিকে ।
ভাগ্য ভালো বলতে হয়, পৌঁছে সিদ্ধার্থ সেনগুপ্তকে তাঁর অফিসেই পাওয়া গেল । দেখা পেতেও বিশেষ অপেক্ষা করতে হ’ল না । ভদ্রলোকের স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখর, পরিচয় দিতেই চিনতে পারলেন – ব্যাপারটা দেখে একটু অবাক হ’লেও মুখে কিছু বললাম না । সাদরে বসিয়ে মন দিয়ে আদ্যোপান্ত শুনলেন । আমার কথার মাঝে প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জেনে নিলেন, যদিও যতটা সম্ভব রেখে-ঢেকেই বললাম । সবশেষে আমাকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন । ওনার বদান্যতায়, সৌভাগ্যক্রমে জুটে গেল স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশনের জন্মাষ্টমীর ভোগ । ওখানে বসেই নানাবিধ কথাবার্তা সেরে, প্রয়োজনে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তখনকার মতো বিদায় নিলাম ।
বাইরে এসে ভাইকে ফোনে সব কথা বলে নিজের পরিকল্পনার কথাও বললাম, সব শুনে ভাই বলল, “যাই করিস সাবধানে আর দেখেশুনে, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা আর কি” । কথা শেষ করে আবার ফিরে চললাম তাজপুর ।
to be continued…
Chapter 4 (Coming soon, 23rd April, 18)